White fang -Jack london

হোয়াইট ফ্যাং-জ্যাক লণ্ডন

প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের চলমান বিকাশের নিরন্তর দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ধরা পড়ে হাতেগোনা যে কয়েকজন সাহিত্যিকের রচনায়, জ্যাক লণ্ডন তাঁদেরই একজন। বিচিত্র জীবনের পথ-পরিক্রমায় তিনি দেখেছেন উত্তরমেরুর তুষারজমা দুর্গম এলাকায় নিষ্করুণ রূঢ় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষসহ জীবজগতের বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর লড়াই। অনুভব করেছেন দুস্তর সমদ্রের বুকে নিষ্ঠুর প্রকৃতির তান্ডবের সঙ্গে ভেসে-চলা দিনরাত্তির, লিখেছেন ছোট কোনও দ্বীপে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের চোয়ালচাপা লড়াইয়ের রোজনামচা । 


বেঁচে থাকার এই যুদ্ধ, এই লড়াই এবং প্রতিকুল প্রকৃতির অকরুণ রূপবর্ণনার পাশাপাশি জীবনের বিকাশ বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে জ্যাক লন্ডনের সাহিত্যে । সে-যুদ্ধে প্রথমত প্রকৃতি যে প্রায়শই বিজেতার ভূমিকা নেয়, অবশেষে একদিন মানুষই প্রভুত্ব কায়েম করে প্রকৃতির ওপর, তা জ্যাক লণ্ডন জানতেন । জানতেন, কারণ প্রকৃতির ভয়ংকর হাঁ-মুখের গভীরে জীবনের অনেক ভোর, অনেক দুপুর, অনেক সন্ধ্যে, অনেক মাঝরাত কাটিয়ে এসেছিলেন তিনি। তাই তাঁর লেখায় প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মানুষ অথবা জীবজন্তুরা কোনও রূপকথার সর্বজয়ী নায়ক কিংবা অপরাজেয় পক্ষীরাজ নয়। এ-যুদ্ধে তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা কখনও জেতে, কখনও হারে, কখনও উঠে দাঁড়ায়, কখনও আছড়ে পড়ে। জিতটা যেমন সত্য, হারটাও তেমনি মিথ্যে নয় ৷ উঠে দাঁড়ানোটা যেমন বাস্তব, আছড়ে পড়াটাও তেমনি অবাস্তব নয়। প্রকৃতি রেয়াৎ করে না কাউকে । প্রতিমুহুর্তের পা-ফেলার ছন্দে এতটুকু ভুল, সামান্যতম অসতর্কতাকেও সে শাস্তি দেয় নির্মম হাতে।

এই সত্য, এই বাস্তবই আদ্যন্ত প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সমুদ্র ও উত্তরমেরুর ক্লনডাইক অভিযানের উপর লেখা উপন্যাস ও গল্পগুলিতে—'কল অফ দ্য ওয়াইল্ড’, ‘সন অফ দ্য উলফ, বেশ কিছু বরফ-জড়ানো অসাধারণ ছোটগল্প, এবং এই ‘হোয়াইট ফ্যাং’-এ। ভবঘুরে জ্যাক লণ্ডন সোনার খোঁজে কানাডা ও আলাস্কার উত্তর মেরু অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছিলেন । সময়টা ১৮৯৭–আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে । জ্যাক লন্ডনের বয়েস তখন একুশ । ক্লনডাইক অঞ্চলে একটা বছর কাটিয়ে ফিরে এলেন লণ্ডন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি হল বেশ কিছু ধ্ৰুপদী ছোটগল্প এবং দুটি ব্যতিক্রমী উপন্যাস–'কল অফ দ্য ওয়াইল্ড' এবং এই 'হোয়াইট ফ্যাং' ।
এ-উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনও মানুষ নয়, এক আধা-কুকুর আধা নেকড়ে, নাম যার হোয়াইট ফ্যাং। উত্তরমেরুর তুষারজমা প্রান্তরে এক গুহায় তার জন্ম। মায়ের ছায়ায় একটু একটু করে চিনতে শিখেছে সে পৃথিবীটাকে । চিনেছে প্রকৃতিকে, চিনেছে তার খাঁজে-খোঁজে লুকিয়ে-থাকা অসংখ্য বিপদকে, শিখেছে কোন কৌশলে কেমন করে পথিবীর শক্ত মুঠো থেকে ছিনিয়ে আনতে হয় জীবনের রসদ—খাদ্য ।

তারপর এসেছে সেই দু-পেয়ে জীব, নাম যার মানুষ। হোয়াইট ফ্যাং গিয়ে পড়েছে মানুষের হাতে । কিছুদিন পর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে তার মা। সরে গেছে ছায়া, জীবনের কড়া রোদ্দুরে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাঁচতে শিখেছে নেকড়েশাবক। একটা-একটা করে শিখে নিয়েছে নির্মম প্রকৃতির মাঝে জীবনযাপনের নিয়মাবলী । অবিরাম লড়াই চালিয়ে গেছে কুকুরদের সঙ্গে, মানুষের নির্দেশে টেনে নিয়ে গেছে মালবাহী স্লেজগাড়ি ।

তারপর নতুন মানুষ, নতুন প্রভু । অত্যাচার আর লড়াই, লড়াই আর অত্যাচার । বুকের মধ্যে কোমলতা বলে কোনও শব্দ নেই, শুধুই ঘৃণা আর ঘৃণা আর ঘৃণা। মানুষের ওপর ঘৃণা, অন্য জীবজন্তদের ওপর ঘৃণা, সারা দুনিয়াটার ওপর ঘৃণা।

সেই ঘৃণার গুটি থেকেই একদিন ডানা মেলেছে ভালবাসার প্রজাপতি । জীবনে এসেছে নতুন প্রভু, এক স্নেহময় মানুষ, তার ভালবাসার ছোঁয়ায় গলে গেছে ঘৃণার বরফ, জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছে হোয়াইট ফ্যাং । পথ চলেছে সে আর চলার পথে সারাক্ষণই শিখে নিয়েছে জীবনযাপনের বর্ণমালা ।

নির্বাক বন্য পশুর চোখ দিয়ে সুদুর বন্য মেরু অঞ্চল থেকে সভ্য ক্যালিফোর্নিয়ার প্রকৃতি ও জীবনকে অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন জ্যাক লণ্ডন। উপন্যাস নয়, জীবনের বর্ণমালা—যে-বর্ণমালা কখনও পুরনো হয় না, হারিয়ে-ফুরিয়ে যায় না। এক অফুরান বর্ণমালার মিছিল ।



0 comments: